এ কথাটি বলেছেন জাপানের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার ড. তারো ইয়ামামতো। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তা যুদ্ধের সমতুল্য। নতুন করনাভাইরসের উত্থান সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। প্রফেসার ইয়ামামতো এক সাক্ষাৎকারে করোনাভাইরাস সম্পর্কে অতি মূল্যবান কিছু কথা বলেছেন।তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাপান এন এইচ কে নিউজের পক্ষ থেকে মিস মায়ুকো ওয়াকুদা।
ডক্টর ইয়ামামতো বলেন, “ করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে যুদ্ধের পরিবর্তে আমাদেরকে ভাইরাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্রফেসার ইয়ামামতো বিশ্বজুড়ে সংক্রামক রোগের শীর্ষ গবেষক। তিনি বলেন, “সে যাই হোক, বর্তমান পরিস্থিতিতে যে মহামারী চলছে তাতে বিভিন্ন সমস্যা উত্থিত হয়েছে – যা আমাদের সংকটবোধের বাহিরে চলে গেছে। যা নাকি সাধারণত সংঘটিত হয় না – তা নিয়ে আপনারা অধিক টেনসনে থাকেন না। এখন সম্ভবত এমন একটি প্রচিচ্ছবি সৃষ্টি হয়েছে যে আমি সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ তার পূর্বাভাস দিতে পারতাম এবং তাহলে সাধারণ জনতার মনে সে সংকটবোধ পূর্বেই জাগ্রত থাকত। “
ওয়াকুদা প্রফেসার ইয়ামামতোকে প্রশ্ন করেন, ‘জাপানে সংক্রামিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আপনি এখন এই সংক্রমণের পর্বটি কোথায় দেখছেন?’
প্রফেসার জবাবে বলেন, “ প্রথমত সামাজিক অবকাঠামোর পতন রোধ করা। আমি মনে করি না যে এখন কোন সর্বরোগ নিবারক ঔষধ আছে। আমি মনেকরি যে ছোট ছোট জিনিষগুলিকে গাদা করে এই মহামারীর মুখামুখি হওয়া সম্ভব।
মিস ওয়াকুদা বলেন, “প্রথমত, ভাইরাসগুলি প্রাকৃতিক জগত থেকে এসেছে।“
প্রফেসর ইয়ামামতো বলেন,” হ্যাঁ, বাস্তুসংস্থায় মানুষের বিশৃঙ্খলা, বিশ্ব উষ্ণায়ন, গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস, এ সব কারণগুলির জন্যে মানুষ এবং বন্য প্রাণীর মধ্যকার দূরত্ব কমে গেছে।সে কারণে, বন্য প্রাণীদের দ্বারা ভাইরাসটি মানুষকে সংক্রমিত করতে পেরেছে এবং মানব সমাজে ভাইরাসটি অতিরিক্ত সংক্রামক হয়ে এসেছে। মানব বিকাশের নামে ইকোসিস্টেমে (জৈবিক সম্প্রদায়ের বসবাসের নির্দিষ্ট পরিবেশ) পা রাখে এবং ক্রমাগত মিথস্ক্রিয়াশীল জিবদের সাথে মানুষের মিশ্রণ এবং বাস্তুসংস্থান হয়েছে – যে স্থানে বন্য প্রাণীরা মূলত বাস করত।তাছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেও মানুষ এবং বন্য প্রাণীদের বাসস্থান অনেক সংকীর্ণ হয়েছে। আমি মনে করি যে এসব কারণগুলির জন্য সংমিশ্রণ ঘটেছে। মানুষ এবং বন্য প্রাণীগুলির মধ্যকার দূরত্বকে বেশ ঘনিষ্ঠ করেছে। এসব পরিবর্তনের জন্য ভাইরাসগুলি মানুষের মধ্যে আসতে পেরেছে। আমি মনে করি যে আরো কিছু কারণে ভাইরাসগুলি মানুষের মাঝে এসেছে। সেগুলি হলঃ বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন নতুন শহরের সৃষ্টি এবং জীব-জানুয়ারের পাশাপাশি মানুষের চলাফেরা ও জীবনযাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে যুগপত বিশ্বব্যাপী মহামারীর সৃষ্টি হয়েছে।“
প্রফেসার বলেন, “মানুষের এমন কর্মকান্ডের ফলে মানব সমাজে এক অজানা ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছে। অতীতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন কেমন করে মহামারীর কারণে মানব সমাজে পরিবর্তন এসেছে। মধ্যযুগীয় মহামারী প্ল্যাগ রোগে ইউরোপীয় সমাজে বিপ্লব ঘটিয়েছে। প্ল্যাগ রোগ ইউরোপের জনসংখ্যা এক তৃতীয়াং শ কমিয়েছিল। তখন গীর্জা কর্তৃপক্ষ তা সামলাতে পারেনি বলে তার পতন হয়, অন্যদিকে জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান হয়েছে। ইয়ামামতো বলেন, “ সেটা হওয়াতে ইউরোপে মধ্যযোগীয় সংস্কৃতির অবসান হয়েছে এবং আধুনিকতা বিকাশ লাভ করেছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে সম্ভবত এই নতুন করোনাভাইরাসের অবসান হলে পৃথিবীতে আরেকটি পরিবর্তন আসবে, হয়তোবা নতুন এক পৃথিবীর আবির্ভাব হবে ।
মিস ওয়াকুদা প্রশ্ন করেন, ‘যারা এখন উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন – তারা কি তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে?’
প্রফেসার ইয়ামামতো বলেন, “সে পরিবর্তন কিভাবে হবে সেকথা বাদ দিয়ে, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনেকরি যে উন্নয়নের সর্বোচ্চ স্তরে মূল্যবোধে পরিবর্তন চলছে। এটি কোন প্রগতির বিকাশ নয়, তবে আমরা পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে ক্রমাগত ভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি, অথবা আমরা এর মধ্যে জীবন যাপনের উপায় অনুসন্ধান করছি। আমি মনেকরি এটাকে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ থেকে আলাদা করে মূল্যায়ন করা উচিত। আমার ধারণা, সম্ভবত একটি টেকসই সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজন। তা হল, সংক্রামক রোগগুলি মোকাবিলা করতে মানব দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন। যে কারণে মানবজাতি পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশে বসবাস করতে সক্ষম হয়েছে। সেই অর্থে যে দিকটি আমাদের লক্ষ হওয়া উচিত – তা হল, একটি সামাজিক দল হিসাবে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করা এবং এই করোনাভাইরাস থেকে যথাসম্ভব মানবজাতির ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা।“
প্রফেসার ইয়ামামতো তাঁর লেখা একটি বই, “ Needs to coexistence with virus.”
ভাইরাসগুলির সাথে সহাবস্থানের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন মিস ওয়াকুদা, “ বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবলে বুঝতে পারি যে জাপান সহ সমগ্র বিশ্বের মানুষ প্রতিদিন এ ভাইরাসের সংক্রমণে ভোগছে। আমাদের সহাবস্তানকে মেনে নেওয়া মুস্কিল। আমরা কেমনে আপনার চিন্তাধারা মেনে নিব?
উত্তরে প্রফেসার ইয়ামামতো বলেন, “যতদিন পর্যন্ত আমরা প্রকৃতির একটা অংশ হয়ে রইব – সংক্রামক রোগও ততদিন থাকবে। আমি মনে করি যে যেহেতু ভাইরাসগুলি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়, আমাদের অন্য কোন পন্থা নেই। যেহেতু ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব নয়, সংক্রামক রোগও থাকবে।
এমন অবস্থায় এটাকে ভাইরাস নির্মূলের সর্বাত্মক যুদ্ধ যলা যায় না। তাই মানবজাতিকে সহাবস্থানে থাকতেই হবে এবং একই সময়ে সংক্রামক সংক্রামক ভাইরাস থেকে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে। আর, আমি মনে করি ভাইরাটি মানবজাতিকে অতিক্রম করে যাচ্ছে কিনা তা বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাইরাসকে মানব সমাজে অন্তর্ভূক্ত করে যথা সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে। আর, এই কাজটি করতে হবে মানব দেহে ভাইরাস প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে। তা হলেই মানবজাতি রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালি হবে। আমার মতে এই ধরণের দৃষ্টিভিঙ্গির প্রয়োজন আছে। আমি আরো মনে করি যে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হবে মানবজাতির প্রতি ভাইরাসটিকে শক্তিশালি হতে না দেওয়া এবং তার সংক্রামক শক্তি হ্রাস করে দিয়ে সাথে ‘মিথোজজীবী (symbiotic) সম্পর্ক স্থাপন করা।
মিস ওকুদাঃ নির্মুল করা যথেষ্ট নয়।
প্রফেসার ইয়ামামতো বলেন, “ এটাকে অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে যাতে এটি মানুষের ক্ষতি বা সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ভেঙে দিতে না পারে,, শুধুমাত্র সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব নয়। আমরা যদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাহত না করি। আমরা ভালভাবেই সক্ষম হতে পারি। সে লক্ষ্যে, আমি বিদ্যমান জ্ঞান বা প্রযুক্তি ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
মিস অয়াকুদা জিজ্ঞাসা করলেন, “সে ধরণের আশা কোথায় পাবেন? সংক্রামক রোগের মহামারী এখন বিভ্রান্তিকর। আপনি যদি আমাদের সমাজের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা খুঁজে পান তবে আপনি সেটা কোথায় পাবেন?
অধ্যাপক ইয়ামামোতো বলেন, “এটি বড় কঠিন প্রশ্ন, এটার প্রকৃত উত্তর নাও থাকতে পারে। তবে প্রতিটি ব্যক্তি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা করে। আমি মনে করি যে কেবলমাত্র একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কল্পনা করেই এই কাজটি তারা করতে পারে। আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার হতে পারে একথা ভেবেই - আমি মনে করি যে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত দ্রুত আসবে না। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আশা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে আমি আফ্রিকাতে গিয়ে এইডসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, কিন্তু তা কার্যকর হয় নি। কারণ (রোগী) ১০ বছর পরে কি হতে পারে, সেকথা কল্পনা করতে পারে না। যদি ১০ বছর পরে, আপনি অনাহার, সহিংসতা বা এইডসের পরিবর্তে যুদ্ধের কারণে মারা যান, "আসুন এখনই এইডস্ প্রতিরোধ করুন যাতে আপনি এখন থেকে ১০ বছর বেঁচে থাকতে পারেন" এই ভাবনা দুর্বল। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি যে সমাজ এখন কেমন এবং কীভাবে সেটার পরিবর্তন হবে এবং প্রতিটি ব্যক্তি এখন মনে কী ধরণের আশা পোষণ করছে। সেই অর্থে, এটি বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তবে আমি মনে করি যে এই পরিস্থিতি পরবর্তীতে আমাদের আশার আলো দেখাবে। এমন যখন ভাবি, মনে প্রশ্ন জাগে। তারপর মানব সমাজ পরিবর্তিত হয়ে কি ধরণের সমাজে পরিণত হবে।“
আরশাদ উল্লাহ্
(মাইক্রবায়োলজিষ্ট)
জাপান।